|

হঠাৎ রেস্টুরেন্টে তিনগুন, পোশাকে দ্বিগুণসহ অন্যান্য খাতে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাব

অর্থবছরের মাঝে হঠাৎ রেস্টুরেন্টে তিন গুন, পোশাকে দ্বিগুণসহ অন্যান্য খাতে ভ্যাট বৃদ্ধি বৃদ্ধির প্রস্তাব: মধ্যবিত্তের নতুন অর্থনৈতিক চাপ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি রেস্টুরেন্ট, মিষ্টির দোকান এবং আরও কিছু খাতের উপর ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে, যা দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য নতুন আর্থিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিবর্তনগুলো মূলত রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং স্থবির মজুরি বৃদ্ধির এই সময়ে এ ধরনের পদক্ষেপ জনসাধারণের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে বিশ্লেষকদের মত।

রেস্টুরেন্ট এবং মিষ্টির দোকানের উপর ভ্যাট ১৫% এ উন্নীত

সরকার রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানের মতো দৈনন্দিন ভোক্তাব্যয় সংশ্লিষ্ট খাতে ভ্যাট ৫% থেকে ১৫% এ উন্নীত করেছে। এ পরিবর্তনের ফলে খাওয়া-দাওয়া এবং মিষ্টান্ন কেনা মধ্যবিত্তের জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।

খাতবর্তমান ভ্যাট হারনতুন ভ্যাট হার
এসি রেস্টুরেন্ট৫%১৫%
মিষ্টির দোকান৭.৫%১৫%

মিষ্টির দোকানের উপর ভ্যাট বৃদ্ধি বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে, কারণ মিষ্টি বাংলাদেশি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উৎসব, জন্মদিন বা যেকোনো বিশেষ দিনে মিষ্টি অপরিহার্য। নতুন ভ্যাটের কারণে এই ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ক্রয় অনেকের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

অন্যদিকে, এসি রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া এখন মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসী খাতে পরিণত হতে পারে। মাঝে মাঝে বাইরে খাওয়া, যা পরিবারগুলোর বিনোদনের একটি অংশ, এখন দ্বিগুণ ব্যয়বহুল হবে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি একগুচ্ছ ভ্যাট বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে, যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় পড়তে চলেছে। রেস্টুরেন্ট, পোশাকের দোকান, মিষ্টির দোকান এবং নন-এসি হোটেল খাতে ভ্যাট ১৫% করা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর উদ্দেশ্য রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) শর্ত পূরণ। তবে, এ পদক্ষেপে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবেন মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

ভ্যাট বৃদ্ধির বিস্তারিত তালিকা

নিচে বিভিন্ন খাতের বর্তমান এবং নতুন ভ্যাট হারের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো:

খাতবর্তমান ভ্যাট হারনতুন ভ্যাট হার
এসি রেস্টুরেন্ট৫%১৫%
পোশাকের দোকান৭.৫%১৫%
মিষ্টির দোকান৭.৫%১৫%
নন-এসি হোটেল সেবা৭.৫%১৫%
হোটেল,রেস্টুরেন্ট ও পোশাক খাতে প্রস্তাবিত নতুন ভ্যাট
হোটেল,রেস্টুরেন্ট ও পোশাক খাতে প্রস্তাবিত নতুন ভ্যাট

রেস্টুরেন্টে খাওয়ার খরচ বাড়ছে

এসি রেস্টুরেন্টের উপর ভ্যাট বাড়ানোর ফলে বাইরে খাওয়া-দাওয়ার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। সাধারণত, পরিবারগুলো মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বিনোদনের উপায় খুঁজে পায়। তবে নতুন ভ্যাট হার এই অভ্যাসকে অনেকের জন্য বিলাসিতায় পরিণত করবে।

পোশাক কেনা হবে আরও ব্যয়বহুল

পোশাকের দোকান, বিশেষত ব্র্যান্ডেড আউটলেটগুলোর উপর ভ্যাট হার দ্বিগুণ হওয়ায় পোশাক কেনার খরচ বাড়বে। এটি ফ্যাশন-সচেতন ভোক্তাদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন পোশাক কেনার ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী উপায় খুঁজতে বাধ্য হবেন।

মিষ্টির দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে

মিষ্টি বাংলাদেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে মিষ্টির দোকানের উপর ভ্যাট ৭.৫% থেকে ১৫% হওয়ায় এখন ঐতিহ্যবাহী এই খাবার অনেকের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। পারিবারিক অনুষ্ঠান, উৎসব কিংবা বিশেষ দিনে মিষ্টি কেনা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

বাজেট হোটেলে থাকার খরচও বেড়ে যাচ্ছে

নন-এসি হোটেল সেবার ভ্যাট ৭.৫% থেকে ১৫% হওয়ায় কম খরচে ভ্রমণের পরিকল্পনাও ব্যাহত হবে। যাঁরা স্বল্প বাজেটে ভ্রমণ করেন, তাঁদের জন্য এই বৃদ্ধি আরও একটি আর্থিক বোঝা হিসেবে কাজ করবে।

সরকারের যুক্তি ও মধ্যবিত্তের সংকট

সরকারের যুক্তি হলো, রাজস্ব বাড়াতে এবং ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য এই ভ্যাট বৃদ্ধি প্রয়োজন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং স্থবির মজুরি বৃদ্ধির এই সময়ে এ ধরনের পদক্ষেপ মধ্যবিত্তের উপর অপ্রয়োজনীয় আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।


বিমানের টিকিটেও ভ্যাটের বাড়তি বোঝা

রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানের পাশাপাশি বিমানযাত্রার উপর ভ্যাট বৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য। নতুন শুল্কের ফলে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় রুটেই ভ্রমণ ব্যয় বেড়ে যাবে।

ভ্রমণের ধরনবর্তমান করনতুন কর
অভ্যন্তরীণ রুট৫০০ টাকা৭০০ টাকা
সার্ক অঞ্চলে ভ্রমণ৫০০ টাকা৭০০ টাকা
এশিয়া অঞ্চলে ভ্রমণ২,০০০ টাকা২,৫০০ টাকা
ইউরোপ ও আমেরিকা৩,০০০ টাকা৪,০০০ টাকা

বিশেষত যাঁরা কর্মসূত্রে বা পড়াশোনার জন্য নিয়মিত ভ্রমণ করেন, তাঁদের জন্য এ খরচ বৃদ্ধির প্রভাব হবে উল্লেখযোগ্য। মধ্যবিত্তের জন্য বিদেশ ভ্রমণ বা অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ আর আগের মতো সহজলভ্য থাকবে না।

মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় প্রভাব

উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির এই সময়ে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে। রেস্টুরেন্টে খাওয়া বা মিষ্টি কেনার মতো সাধারণ আনন্দগুলো এখন অনেকের জন্য আর্থিক বোঝা হয়ে উঠতে পারে।

অন্যদিকে, বিমানের টিকিটের ওপর বাড়তি শুল্ক ভ্রমণ খাতের উপরও প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ ভোক্তা ব্যয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বাজারে মন্দাভাব সৃষ্টি করতে পারে।

সরকারের অবস্থান

সরকার অবশ্য বলছে যে, এসব পরিবর্তন রাজস্ব আয় বাড়ানোর এবং আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। এ অবস্থায় ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানোই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন:
“রাজস্ব বাড়ানো প্রয়োজন, কিন্তু সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময় এমন সিদ্ধান্ত মধ্যবিত্তের উপর আর্থিক চাপ বাড়াবে।”

ছোট ব্যবসার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ

ছোট ব্যবসাগুলোর জন্য ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ৩০ লক্ষ টাকার বেশি বার্ষিক টার্নওভার থাকলেই ব্যবসাগুলোকে ভ্যাটের আওতায় আসতে হবে। এ পরিবর্তন অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য অতিরিক্ত ট্যাক্স সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি করবে এবং তাদের টিকে থাকা কঠিন করে তুলতে পারে।

রেস্টুরেন্ট, মিষ্টির দোকান এবং অন্যান্য খাতে ভ্যাট বৃদ্ধি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টার একটি অংশ। তবে, এটি মধ্যবিত্ত ও ছোট ব্যবসার উপর উল্লেখযোগ্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।

এই পদক্ষেপের বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এর প্রভাব জনগণের জীবনযাত্রা এবং ভোক্তা ব্যয় কীভাবে প্রভাবিত করবে, তা পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সমন্বয়মূলক পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠীগুলো সুরক্ষিত থাকে।

Similar Posts