বাংলাদেশ ভারতে ৩,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিল দুর্গাপূজা উপলক্ষে
বাংলাদেশ ৩,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিল ভারতে দুর্গাপূজা উপলক্ষে
বাংলাদেশ সরকার দুর্গাপূজা উদযাপনকে সামনে রেখে ভারতের জন্য ৩,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। রপ্তানিকারকরা এই অনুমোদনের জন্য ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। প্রতিবছরই দুর্গাপূজার সময় ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের জন্য ইলিশ রপ্তানি করা হয়। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি, যা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এর আগে বাংলাদেশ সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ইলিশের সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভারতের জন্য ইলিশ রপ্তানি স্থগিত করেছিল। মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এবং উৎসবের সময় মানুষের চাহিদার দিকে নজর রেখে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সাধারণত ইলিশ রপ্তানির বিষয়টি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ইলিশ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদ, যা দেশের খাদ্য সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বও বহন করে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অগ্রাধিকার দেননি। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার আগে বলেছিলেন যে, সরকার স্থানীয় বাজারে চাহিদা মেটানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে, বিশেষ করে উৎসবের মৌসুমে ইলিশের উচ্চ চাহিদার কারণে। দেশের জনগণের ইলিশের প্রতি অনুরাগকে মাথায় রেখেই সরকার রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা সীমিত পরিসরে।
ভারতে ইলিশের চাহিদা বৃদ্ধি
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশি ইলিশের চাহিদা প্রচুর। ইলিশ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বিশেষ খাদ্য এবং উৎসবের সময় এটি একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজার সময় ইলিশের চাহিদা এত বেশি থাকে যে, এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানির জন্য বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়। ইলিশের এমন জনপ্রিয়তার কারণে প্রতি বছরই বাংলাদেশ সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে থাকে। তবে, এটি সাধারণত কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়নের একটি অংশ হিসেবে করা হয়।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BFFEA) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এই বছরের অনুমোদনের চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান যে, ইলিশ রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা কয়েক বছর ধরে বহাল থাকলেও, সরকার প্রতি বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে এ নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে। তার মতে, এই বছরের রপ্তানি অনুমোদন ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলাফল হতে পারে।
বেলায়েত হোসেন আরও বলেন, “ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় ইলিশ রপ্তানির অনুরোধ আসে। ভারতীয়দের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং আমাদের সরকারও সেই সম্পর্ককে সম্মান জানাতে রপ্তানি অনুমোদন দেয়। তবে, স্থানীয় বাজারে ইলিশের দামের উপর এর প্রভাব নিয়েও আমাদের সচেতন থাকতে হবে।”
২০২৩-২৪ অর্থবছরে, বাংলাদেশ ৬৬৪.৮৬ টন ইলিশ ভারতকে রপ্তানি করেছে, যার মূল্য ৭.৭১ মিলিয়ন ডলার, যা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী।
এর আগের অর্থবছর ২০২২-২৩ সালে, বাংলাদেশ ১,৩৭৬.৪২ টন ইলিশ রপ্তানি করেছে, যার মূল্য ছিল ১৩.৬৮ মিলিয়ন ডলার, এবং সেই বছরে মোট উৎপাদন ছিল ৫,৭১,৩৪২ টন।
বাংলাদেশের বাজারে ইলিশের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি
তবে, রপ্তানির এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম থাকায় এবং দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে ইলিশের সংকট চলছে, যার ফলে ইলিশের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। অনেকেই মনে করছেন, ভারতের জন্য রপ্তানি করা হলে স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। এমনকি ইলিশ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে, যা সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় আঘাত।
বাংলাদেশের একজন ক্রেতা, রাশেদা বেগম, বলেন, “ইলিশ তো আমাদের দেশের সম্পদ। দেশের বাজারে ইলিশের এমন চাহিদা, অথচ আমরা ঠিকমতো কিনতে পারছি না। এখন আবার ভারতের জন্য রপ্তানি করলে তো দামের আরও বৃদ্ধি হবে। আমরা কিভাবে খাব?” এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে, যেখানে মানুষ ইলিশের দামের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, দেশের জনগণের চাহিদা পূরণ না করে ইলিশ রপ্তানি করলে স্থানীয় বাজারে এর অভাব দেখা দেবে, যা শুধু দামের উপর প্রভাব ফেলবে না, বরং মানুষের মাঝে অসন্তোষ বাড়াবে। যদিও সরকার প্রতিটি রপ্তানির আগে স্থানীয় সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবুও পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বাজারে ইলিশের সংকট কমছে না।
ভারতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে, ভারতের মাছ আমদানিকারকরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। ভারতের ফিশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সৈয়দ আনোয়ার মকসুদ বলেন, “আমরা অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি, এবং এই সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক উন্নয়ন। দুর্গাপূজার সময় পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের চাহিদা প্রচুর, এবং বাংলাদেশ সরকারের রপ্তানি অনুমোদন আমাদের সেই চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে।”
ভারতীয় আমদানিকারকরা বিশ্বাস করেন, এই রপ্তানি ভারতের বাজারে ইলিশের দাম স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে। তবে, ভারতীয় বাজারে ইলিশের দাম বাড়ার আশঙ্কা কম থাকলেও, বাংলাদেশি বাজারের অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত হতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশে ইলিশের অভাব এবং দামের বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। দেশের বাজারে ইলিশের ঘাটতি থাকায় এবং প্রয়োজনের সময় উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেই ইলিশ কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছেন। দুর্গাপূজা উপলক্ষে ৩,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদনের খবরে দেশজুড়ে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, যখন দেশের বাজারে ইলিশের সংকট রয়েছে, তখন এ ধরনের রপ্তানি দেশের মানুষের জন্য চাপ তৈরি করছে।
স্থানীয় ভোক্তাদের অভিযোগ, ইলিশের উচ্চমূল্য এবং সীমিত সরবরাহের কারণে তারা উৎসবের সময়ও ইলিশ কিনতে পারছেন না, যা তাদের অসন্তোষের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামনের দিনে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ চিন্তা
প্রতিবছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইলিশ রপ্তানি করা হয়, যা দুই দেশের মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তবে, এ বছর ইলিশের রপ্তানি নিয়ে যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, তা ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হতে পারে। ইলিশের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, তাতে স্থানীয় বাজার এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে? অনেকেই মনে করছেন, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও সম্ভব হয়। এছাড়াও, ইলিশ রপ্তানির উপর সীমিত সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি দেশের জনগণের চাহিদা পূরণের দিকে নজর দেওয়া উচিত।