অপরাধ বৃদ্ধির জন্য টিভি সিরিয়াল দায়ী বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
অপরাধ বৃদ্ধির জন্য সিনেমা ও সিরিয়াল দায়ী, অভিযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের: সমাজের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি
পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ধর্ষণ, হত্যা এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিনেমা, টিভি সিরিয়াল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত কুরুচিপূর্ণ ভিডিওগুলোকে দায়ী করছেন। রাজ্যে চলমান অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনি সমাজের দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি মনে করেন, এই সব মাধ্যম শিশুদের উপরও খারাপ প্রভাব ফেলছে।
রোববার (৬ অক্টোবর) কলকাতা পুলিশের আবাসিক পূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, “ইউটিউবের প্রভাব পড়ছে শিশুদের মধ্যে। তারা সেখান থেকে নেতিবাচক বিষয়গুলো শিখছে। আমরা যদি সময় মতো সতর্ক না হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।”
এছাড়াও তিনি অভিযোগ করেন, টিভি সিরিয়াল এবং সিনেমাগুলোতে অতিরিক্ত অপরাধমূলক দৃশ্যের প্রভাবও কম নয়। “টেলিভিশনের প্রায় সব সিরিয়ালে অপরাধের দৃশ্য দেখানো হয়। নতুন সিনেমাগুলোতেও ক্রাইম সিনে ভরপুর। আমি সিনেমাকে ছোট করছি না। বরং বাংলা সিনেমার আরও উন্নতি হোক, তা আমি চাই। কিন্তু যেভাবে টিভি সিরিয়ালগুলোতে অপরাধের গল্প তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে দর্শকরাও প্রভাবিত হচ্ছে এবং অনেকে সেই অপরাধগুলো অনুসরণ করছে।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “কিসের জন্য এত ক্রাইম দেখানো হবে? সমাজকে কেন অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এই নির্মাতাদের কি কোনও দায়বদ্ধতা নেই? শুধু পুলিশ বা সরকারের দোষারোপ করলেই হবে না, আমাদের নিজেদের দায়বদ্ধতাও কোথায়?”
সাম্প্রতিক কয়েকটি ভয়াবহ অপরাধের ঘটনায় রাজ্য জুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। ৯ আগস্ট কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে এক শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে যখন রাজ্য উত্তাল, তার কিছুদিন পরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে ৯ বছরের এক ছাত্রীর সঙ্গে একই ধরনের নৃশংস অপরাধ ঘটে। এরপর পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে এক নারীকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্তকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে।
এইসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য উঠে আসে, “পশ্চিমবঙ্গে কিছু ঘটনা ঘটলেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। আমি একথা বলছি না যে, মানুষের প্রতিবাদ করা উচিত নয়। বরং তাদের সেই অধিকার আছে। কিন্তু কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এসব অপরাধ ঘটায় না।”
মুখ্যমন্ত্রী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)-এর অপব্যবহার নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “এখন এআই-এর যুগ। আমার ছবি, আমার শরীর, আমার কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে ভুয়া ভিডিও তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো আসল নয়। মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে এই ভুয়া ভিডিওগুলোর বিরুদ্ধে।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এই ধরনের ভুয়া ভিডিও এবং অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে সকলকে একত্রিত হতে হবে। তার দৃঢ় বার্তা, “অপরাধ শুধু অপরাধ। এর সঙ্গে কোনো ধর্ম, বর্ণ বা জাতির সম্পর্ক নেই। যেই এই অপরাধ করবে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে মমতার এই বক্তব্যে রাজ্যের বিরোধী শিবির থেকে সমালোচনা আসছে। বিশেষ করে, আরজিকর হাসপাতালের ঘটনায় নির্যাতিতার মা (ছদ্ম নাম অভয়া) বলেছেন, “কোনটা ঘটনা আর কোনটা দুর্ঘটনা তা রাজ্যবাসী বুঝতে পারছেন। পুলিশ যদি প্রমাণ নষ্ট না করত, তাহলে মেনে নিতে পারতাম যে আমার মেয়ের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা নিছক দুর্ঘটনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে রাজ্যটি মুখ্যমন্ত্রীর হাতে নয়, পুলিশের হাতে চলছে। এ কারণেই বাংলায় অপরাধের মাত্রা এত বৃদ্ধি পেয়েছে।”
রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে যে সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রশ্নগুলো উঠছে, তা মোকাবিলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তবে তার অভিযোগ এবং সমাধান নিয়ে বিতর্ক থামার কোনও লক্ষণ নেই। সমাজের দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা আরও জোরালো হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক অপরাধের ঘটনার প্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজ ও মিডিয়ার দায়বদ্ধতার ওপর জোর দিলেও, এর সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক এখনও অব্যাহত। বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপই এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।